ষ্টাফ রিপের্টিারঃ কুড়িগ্রামের ডিসি’র ব্যক্তিগত আক্রোশে গভীর রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাংবাদিককে কারাদন্ড দেয়ার রেশ না কাটতেই এবার কুড়িগ্রাম জেলা জজ আদালতের ক্যাশিয়ার আনসার আলী এবং অফিস সহায়ক মোশারফ আলী’কে সাজা দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিজিৎ চৌধুরী। ৪ মে, সোমবার এ সাজা দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে কুড়িগ্রাম জেলা জজ আদালতের কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৫,৮০,১৩০/- (পাঁচ লক্ষ আশি হাজার এক শত ত্রিশ) টাকা উত্তোলন পূর্বক দুপুর ০১:১৫ হতে ২:০০ ঘটিকার মধ্যে রিক্সায় যাত্রী হিসেবে আরোহী হয়ে আদালতের দিকে যাওয়ার পথে মোবাইল কোর্টের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দু’জনে রিক্সায় উঠার অভিযোগে এনে সাজা দেন। এতগুলো টাকা একজনের পক্ষে নিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, সেকারণ দু’জন যাচ্ছি-এরকম নানা কথা বলেও ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মন গলাতে পারেনি আদালতের দায়িত্বে থাকা দু’কর্মচারী। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ এর ২৫(১)(খ) ধারায় বর্ণিত অপরাধ সংঘটন করেছেন মর্মে উল্লেখে উক্ত আইনের ২৫(২) ধারা মোতাবেক দোষী সাব্যস্থ করে জরিমানা করেছেন। এ নিয়ে আদালতের কর্মচারী এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ, নিন্দা জানানো হয়েছে। সন্দেহ নেই এর রেশ আরো কিছুদিন চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা পি.এম. সিরাজুল ইসলাম (সিরাজ প্রামাণিক) এর চিঠির সারমর্ম পাঠকের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হলো।
যে আইনের ধারায় সাজা দিয়েছেন, প্রথমত তিনি তিনি এ আইনের ব্যবহারই করতে পারবেন না। এবার জেনে নেয়া যাক কি আছে এ আইনে।
২৫ (১) যদি কোনো ব্যক্তি-
(ক) মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তাহার উপর অর্পিত কোনো দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এবং
(খ) সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন,
তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদ-ে, বা অনূর্ধ্ব ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদ-ে, বা উভয় দ-ে দ-িত হইবেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল যে, এ রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কোনো নির্দেশ পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। এখানে তিনজন ব্যাক্তির কথা বলা হয়েছে। কোথাও নির্বাহী ম্যাজিেেস্ট্রটের কথা বলা হয়নি।
ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সাথে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোন রকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স বলেছেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। ভ্রাম্যমান বিচার ব্যবস্থায় উপরোক্ত দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো আইন মানবতা বিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।
সত্যি বলতে কি, আমলাচালিত কোর্টকে ক্যাঙারু কোর্টের সঙ্গে তুলনা করলে অত্যুক্তি হয় না। ক্যাঙারু কোর্টে যিনি প্রসিকিউটর, তিনিই বিচারক। মোবাইল কোর্টেও তা-ই; বরং ক্যাঙারু কোর্টে আসামি আইনজীবীর সুবিধা পান। মোবাইল কোর্টে তা-ও লাগে না। ১৯০ ধারার ৪ উপধারার অবিলম্বে বাতিল চাই। সামারি ট্রায়ালের ক্ষমতা দাবি করাকে ডিসিদের পক্ষে গুরুতর পেশাগত অসদাচরণ বলে দেখা উচিত। বিচার বিভাগকে সজাগ থাকতে হবে। মোবাইল কোর্টের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের অবিলম্বে সুরাহা হওয়া উচিৎ। ভারত ডিসিদের দ্বারা জজিয়তি না করিয়ে যদি সুশাসন ও প্রবৃদ্ধি দুটোই দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ অক্ষম হবে কেন।
যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।